দৈত্যকুলে তরণীসেন

 

চিত্রঋণ -- আন্তর্জাল


'দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ' -- এই প্রবাদটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। রাক্ষস-রাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র সেই হরি-ভক্ত প্রহ্লাদ... যাকে চরম সংকটে রক্ষা করতে নরসিংহ অবতার রূপে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন। বধ করে পাপ-জন্ম থেকে মুক্তি দেন হিরণ্যকশিপুকে। সেরকম রামায়ণেও দৈত্যকুলে এক রাম-ভক্ত ছিল... তরণীসেন। যদিও, তরণীসেনের চরিত্র বা পরিণতি প্রহ্লাদের মতো নয়। বরং উল্টোই। সত্যি বলতে... তরণীসেনকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা চারিত্রিক বিশ্লেষণের অবকাশও নেই। বিভীষণ এবং সরমার পুত্র তরণীসেন একেবারেই বাঙালীর নিজস্ব। কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কা কাণ্ডে যে তরণীসেন বধের অধ্যায়... তা বাল্মিকী রামায়ণে নেই। বাল্মিকী রামায়ণে তরণীসেন চরিত্রটিই নেই! 

পর পর দু'জন রাক্ষস সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর নিকষার তৃতীয় সন্তানটিও হয়ত রাক্ষস-মতি হবে বলেই প্রত্যাশা করেছিল দৈত্যকুলের সকলে। কিন্তু বিভীষণ পেয়ে গেল পিতা বিশ্রবার জেনেটিক ট্রেট... ধার্মিক মতি। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ যেমন ব্যতিক্রম, তেমনই ব্যতিক্রম বিভীষণ। বেদজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞ দশাননও ছিল। গুণ এবন জ্ঞান তারও কম নয়। কিন্তু বিভীষণ রাক্ষস হয়েও ছিল নেকড়ের পালে ভেড়ার মত। তবে সে জ্ঞানী, বিচক্ষণ... চুপচাপ অনেক কিছুই দেখত, বুঝত... যেন অপেক্ষা করত উপযুক্ত মুহূর্তের। রাবণকে প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে সেই উপযুক্ত মুহূর্ত এলো... নিজের পথে চলার পরিকল্পনা নিল বিভীষণ। রাবণ যে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই অপমানও ভুলেছিল বলে মনে হয় না। তারপর কী কী করল, মোটামুটি সবাই জানি। 

     এই বিভীষণেরই পুত্র তরণীসেন। দৈত্যকুলেরই একজন, কিন্তু বাপ-ঠাকুর্দার মতো সাত্ত্বিক, ধার্মিক... এবং রাম-ভক্ত। অথচ তার কর্তব্য-নিষ্ঠা একেবারে অন্যরকম। বিভীষণ রাবণের শিবির ত্যাগ করে চলে গেল রামের দিকে। তরণীসেন গেল না। রাবণ যখন বিভীষণকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছে, বিভীষণ রামকে লঙ্কার বিরুদ্ধে মন্ত্রণা দিচ্ছে... সেই কথা বলছে; তরণীসেন সেই প্রসঙ্গেও গেল না। বলল -- পিতার ব্যাপারে আলোচনা করা উচিৎ না। মা সরমাকে বলল -- আমি জানি শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার, যদি দাসের সন্তান বলে না মারেন, তাহলে ফিরব... না হলে বৈকুন্ঠলোকে স্থান হবে। তরণীসেন যুদ্ধ করল রামের বিরুদ্ধে, রাক্ষস সেনা নিয়ে এগিয়ে গেল... গঙ্গা-মাটি দিয়ে পতাকায় আর রথের সর্বাঙ্গে রাম-নাম লিখে!

  কৃত্তিবাসের সৃষ্টি এক অদ্ভুত ট্র্যাজিক নায়ক তরণীসেন। স্বল্প উপস্থিতি... অথচ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তিন প্রহর যুদ্ধের পর রাক্ষস যোদ্ধা মকরাক্ষ বীরগতি প্রাপ্ত হল। ঠিক তখনই কৃত্তিবাস জন্ম দিলেন তরণীসেন চরিত্রের। লঙ্কাকাণ্ডের এক ছোট্ট অধ্যায় -- তরণীসেনের যুদ্ধ ও পতন। অবতার শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই সে গেল সমরে।  রাম-লক্ষণ ও পিতা বিভীষণের দর্শন করবে... এই উদ্দেশ্য। যুদ্ধ প্রান্তরে প্রবেশ করেই খুঁজতে লাগল... তারা কোথায়। এক এক করে বানর যোদ্ধাদের পরাস্ত করে যখন রামকে দেখতে পেল, তখন প্রণাম করে স্তুতি করতে শুরু করল তাঁর। শ্রীরাম বিভীষণকে জিজ্ঞেস করলেন -- "শত্রুপক্ষে এ কে যে আমার স্তুতি করে?... আমাদের কেন প্রণাম করে?" বিভীষণ নিজের পুত্র-পরিচয় গোপন রেখে বলল, রাবণের জ্ঞাতি... ভাইয়ের ছেলে; ধার্মিক যোদ্ধাপতি। জানাল --

"প্রভু, না জান কারণ!

লঙ্কাপুরে ও তোমার ভক্ত এক জন।।

তোমার চরণ বিনা অন্য নাহি জানে ।

আসিয়াছে সংগ্রামেতে রাজার শাসনে।।"

ঠিক এইখানেই 'দৈত্যকুলে তরনীসেন'-এর চরিত্র খোদাই করে দিয়েছেন কৃত্তিবাস। পাঠকের কল্পনায় ফুটে উঠবে বিভীষণের অতীত, এবং তার পুত্র হিসেবে তরণীসেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। 

তখনই হয়ত পরিস্থিতি সামলে নেওয়া যেত। আসন্ন অঘটন এড়ানো যেত। কিন্তু তা ঘটল না। তরণীও আক্রমণ করল, রামচন্দ্রও সবাইকে থামিয়ে বিভীষণকে চেপে ধরে বললেন না "ব্যাপারটা খোলসা করে বল তো?" কিন্তু এ তো কৃত্তিবাসের নিজস্ব সৃষ্টি! উনি তরণীকে বিভীষণের পাশে দাঁড় করালেন না। তরণীসেন একই সঙ্গে ধার্মিক এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। সে লড়ে গেল শ্রীরামের সেনার বিপক্ষে। এক এক করে সকলে এল, কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারল না। রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঝেই তাঁর মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শন করল তরণীসেন! শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করতে বসল অস্ত্র ত্যাগ করে। সেই বন্দনাও কৃত্তিবাসের এক সচেতন প্রয়াস, যা শুনে রাম চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছেন "লঙ্কায় এমন ভক্ত আছে? এই লঙ্কা আক্রমণ করে কী হবে? কীভাবে বধ করব এমন ভক্তদের?" একটি কনট্রাস্টের কী চমৎকার দৃশ্যায়ন। মহাভারতে অর্জুন এই দ্বিধাতেই অস্ত্র তুলতে পারছেন না, শ্রীকৃষ্ণ গীতা উপদেশ দিচ্ছেন। বিশ্বরূপ দর্শন করাচ্ছেন অর্জুনকে। আর এখানে তরণীসেন বিশ্বরূপ দর্শন করছে, তার বন্দনা শুনে অবতার স্বয়ং বলছেন "কী করব যুদ্ধ করে? কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলছি?" 

যুদ্ধ ত্যাগ করে বনে ফিরে যেতে চাইছেন শ্রীরাম, এই অঘটন দেখে তরণীসেন আবার তাদের উসকে দিল সীতার উদ্দেশ্যে কটু কথা বলে।  আবার যুদ্ধ শুরু হল। লক্ষ্মণ পিছু হটল, রামও নাজেহাল হলেন। রণক্লান্ত তরণীসেনও ভাবছেন "আর কতক্ষণ?"! 

অবশেষে আবার সেই বিভীষণ নিজের কাজটা করে দিল, জানিয়ে দিল রামকে - 

"শুনো প্রভু রঘুনাথ! করি নিবেদন।

ব্রহ্ম অস্ত্রে হইবেক উহার মরণ।।

অন্য অস্ত্রে না মরিবে এই নিশাচর।

সদয় হইয়া ব্রহ্মা দিয়াছেন বর।।"

শ্রীরাম ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেখে তরণীসেন বুঝল, তার যুদ্ধে আসার উদ্দেশ্য পরিণতি পেতে চলেছে, রাক্ষস-দেহ থেকে মুক্তি আসন্ন। শেষ বারের মতো শ্রীরামকে প্রণাম জানাল --

"তোমার চরণ হেরে পরিহরি প্রাণ।

পরলোকে প্রভু! শ্রীচরণে দিও স্থান।।

এতেক ভাবিতে বাণ অঙ্গে এসে পড়ে।

তরণীর মুণ্ড কেটে ভূমিতলে পড়ে।।

দুইখণ্ড হ'য়ে বীর পড়ে ভূমিতলে।

তরণীর কাটামুণ্ড রাম রাম বলে।। "


এরপর অবশেষে বিভীষণ কী বলছে, কীভাবে রামের কাছে প্রকাশ করছে যে তরণীসেন ওরই ছেলে... সেইসব ঘটনা আসে। রাবনের শোক, সরমার বিলাপের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু তরণীসেনের এই পরিণতির পরে সবকিছুই ম্লান মনে হয়ে। কৃত্তিবাস এই স্বল্প পরিসরে তরণীসেনকে একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন যা সত্যিই মনে রাখার মতো একটা প্রয়াস। কিন্তু প্রশ্ন জাগে --

 তরণীসেনের চরিত্র কল্পনা কেন করলেন কৃত্তিবাস? ঠিক কোনদিকটা দেখানোর ইচ্ছে ছিল? দৈত্যকুলে তরিণীসেনের মতো লোকও আছে, এটা দেখানো? বিভীষণের যে নেতিবাচক দিক, তা তরণীসেনের মধ্যে ছিল না... তরণী কর্তব্য এবং ধর্মভারে আবেগতাড়িত হয়ে প্রাণত্যাগ করল, বিভীষণ হল লঙ্কাধিপতি... এইটা দেখানোর জন্য? যে কোনো কারণেই হোক, শুধুমাত্র রামের হাতে মরলে মুক্তি পেয়ে বৈকুন্ঠলোকে যাবে -- এই দেখানোর জন্য তরণীসেন চরিত্রটি এনেছেন বলে মনে হয় না। তরণীসেনের নিজস্বতা আছে, প্রভাব আছে। রাম ইচ্ছে করলেই তরনীসেনকে না মেরে বিকল্প কিছু ভাবতে পারতেন, তা যে হল না... এও কৃত্তিবাসের ইচ্ছেতেই। বেঁচে গেলে তরণীসেন সস্তা হয়ে যেত, বিভীষণের মতো 'টু-ফেস' হয়ে যেত।  মাইকেল মধুসূধন দত্ত অনেক পরে 'মেঘনাদ বদ' কাব্যে ইন্দ্রজিৎ এবং রাবণকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছিলেন... কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে বসে কৃত্তিবাসের চিন্তায় 'তরণীসেন'-এর আগমন, এও এক রকম মনে রাখার মতো অবদান। নিজেই যেন একটা মিনি মহাকাব্য, অথবা মহাকাব্যের বীজ। পরবর্তী কোনো কবির প্রচেষ্টা হয়ত তরণীসেনকে নিয়েও বড়ো কাজ হতে পারত। হয়ে ওঠেনি। 


   আর এই যে বললাম, বাল্মিকী রামায়ণে 'তরণীসেন' চরিত্রটি নেই, এই প্রসঙ্গেই বলি --  বাল্মিকী রামায়ণে আছে বিভীষণের কন্যা ত্রিজটার কথা। ত্রিজটা নারী, সে যুদ্ধ করবে না। সে ছিল তার মা সরমার মতই অশোকবনে বন্দিনী সীতার ছায়া সঙ্গিনী। ত্রিজটা কখনো রাবনের গুপ্তচর, রাবণের মন্ত্রনার অংশ। আবার কখনো সে সীতার দুঃখের সঙ্গী, তার মনোবল বাড়াচ্ছে... সীতাকে বোঝাচ্ছে, সে যাতে অবসাদে দুর্দশায় প্রাণত্যাগ না করে । কৃত্তিবাসের চেড়ীরা অন্যরকম, তারা উৎপীড়ন করে সীতাকে। কটু কথা বলে। সেখানে ত্রিজটা বা তার মতো কেউ নেই। 

ত্রিজটার মন্দির আছে কাশীতে, সেখানে মেয়েরা ব্রত-উপবাসও করে ত্রিজটার আরাধনায়। এমনকি উজ্জয়িনীতেও আছে ত্রিজটাকে নিবেদিত মন্দির। এমনকি ভারতের বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যেখানে রামায়ণ-গাথা মিশে আছে সংস্কৃতিতে, সেখানেও ত্রিজটার বিশেষ অস্তিত্ব আছে। অথচ ত্রিজটার সীতামাতা তাকে অযোধ্যায় নিয়ে গেলেন না, বললেন "সেখানে রাক্ষসীদের থাকা অসুবিধে... তুমি বরং বারানসী গিয়ে মোক্ষ লাভ করো।" 

আবার, তেলুগু মহাকাব্য 'সীতা পুরণামু' তে কবি ত্রিপুরানেনী রামস্বামী বিভীষণকে দ্রাবিড়িয় এবং সরমাকে আর্য্য রমনী হিসেবে পোর্ট্রে করেছিলেন। সরমা এমন এক আর্য্য রমনী যার পরামর্শে ক্রমে বিভীষণ দ্রাবিড়ের থেকে দূরে সরে যায়, নিজের হিতাহিত বুঝে রামের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সরমা চেয়েছিল আর্য্য রঘুপতির বিজয়, এবং রাক্ষসকুলের নাশ। আর্য্য সরমার কন্যা ত্রিজটাও মায়ের শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়েছিল। সরমা আর ত্রিজটার সেবা আর সহৃদয় ব্যবহার রাক্ষস-গৃহে বন্দিনী সীতার বড়ো সহায় হয়ে উঠেছিল। অবশেষে সরমা এবং ত্রিজটাকে সীতার সঙ্গেই অযোধ্যায় চলে যায়।   

ত্রিজটাকে নিয়েও কিছু আলোচনার অবকাশ থেকে, কিন্তু বাঙালীর নিজস্ব তরণীসেনের উদয় আর পরিণতি রীতিমতো এপিক-ড্রামার মত। তাই সেই নিয়ে বেশি বলা হয়ে গেল।


[বৈশাখ, ১৪২৭]


পৃথক গৌরাঙ্গ ভজনের গ্রাম– কেতুগ্রামের বিরাহিমপুর -- সম্পর্ক মণ্ডল

 



রাঢ়বাংলায় আমরা যদি একবারে উত্তর প্রান্তে হাজির তাহলে আমরা দেখবো একের পর এক বৈষ্ণবতীর্থ গ্রাম, যেখানকার ভূমি পবিত্র হয়ে বৈষ্ণবীয় ভাবরসে। বিরাহিমপুরও তেমন একটি গ্রাম, যেটা উত্তর রাঢ় তথা পূর্ব বর্ধমানের গঙ্গাটিকুরি আর ঝামটপুর-বহরানের মধ্যে অবস্থান করলেও তার কয়েক মিটার দূরেই অবস্থিত মুর্শিদাবাদের সীমানা। তবে মধ্যযুগ থেকে এর অবস্থান বিচার করলে এটি মনোহর শাহি পরগণার অন্তর্গত। সেই বৈষ্ণব ভাবে সিক্ত মনোহর শাহি পরগণা, যেখানে থেকে মনোহর শাহি কীর্তনের সূত্রপাত ঘটে। কাঁন্দরা, সোনারুন্দি, দক্ষিণখন্ড বা এই বিরাহিমপুর গ্রামাঞ্চলে আজও মনোহর শাহি কীর্তনীয়ারা কেউ কেউ বাস করেন। এখানে উল্লেখ্য যে বিখ্যাত কীর্তনীয়া যদুনন্দন দাস এই বিরাহিমপুরেরই বাসিন্দা ছিলেন, আজও তার বংশধরদের কেউ কেউ এই গ্রামে বাস করে। যায় হোক, মনোহর শাহি পরগণার পরিচয় বাদ দিলেও এর আর একটি পরিচয় হল এটি কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত একটি বৈষ্ণব গ্রাম, যেখানে সশিষ্য স্বয়ং নিত্যানন্দ মহাপ্রভু এসেছিলেন এবং তিনি বিনোদ দিঘির পারে বৃক্ষতলে বিশ্রাম করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন দীক্ষালাভের পর চৈতন্যদেব রাঢ়ভ্রমণে বেরিয়ে এখানে এসেছিলেন কিন্তু এই তথ্যের সপক্ষে কোনও যথাযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অজয়-গঙ্গার সংযোগস্থলে কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নিয়ে চৈতন্যদেব রাঢ়ভ্রমণ করেছিলেন তা সত্য কিন্তু তার যাত্রাপথে বিরাহিমপুর ছিল না, কারণ তিনি অজয় তীর ধরে ভ্রমণ করে রসুই গ্রামে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, পরে সুস্বাদু আহার্যে তার দেহে বল আসলে তিনি স্থানটির নাম 'রসবতী ' রেখেছিলেন, পরে তা রসুই গ্রাম নামে পরিচিত হয়, তারপরে তিনি কেতুগ্রাম হয়ে ঈশানী নদী ধরে নৌকাযোগে গঙ্গাটিকুরির পাশ দিয়ে গিয়ে উদ্ধারণপুরে ঘাটে পৌঁছেছিলেন এবং শান্তিপুর যাত্রা করেছিলেন উদ্ধারণপুর থেকে। তাই কোনওভাবেই তিনি বিরাহিমপুর যান নি, এটুকু নিশ্চিত। অনেকে বিরাহিমপুরকে বিরুমপুর বলেও ডাকেন, এর পিছনে একটি ছোট্টো ইতিহাস আছে। সেনরাজা লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসন অনুযায়ী, তার মা তাদের পুরোহিতকে পাঁচটি গ্রাম দান করেছিলেন, যা বর্তমানে বালুটিয়া ( বাল্পছীটা ),  খাঁড়ুলিয়া ( সোমালিয়া) , মুরুন্দি ( মোড়লডিহি), জলসুতি ( জলশৌখি) এবং কিয়তরাল ( রাউন্দি) বলে পরিচিত, অর্থাৎ এই গ্রামগুলি সাথে একইসাথে বিরুমপুরের অস্তিত্ব লক্ষ্মণ সেনের আমলে ছিল না। পরে মুসলিম আক্রমণ শুরু হলে এই অংশটির অবস্থান অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে হওয়ায় এখানে একদল মুসলিম বসবাস শুরু করে এবং আজকের বিরাহিমপুরের তৎকালীন নাম ছিল 'ডাঙাপাড়া', কেউ কেউ বলেন ইব্রাহিম নাম সেনানী নাম থেকে বিরাহিমপুর শব্দটি এসেছে কিন্তু কাটোয়া মহকুমার মধ্যযুগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সম্পূর্ণ অন্য তথ্য, স্থানীয় গ্রাম দত্তবরুটিয়ার প্রভাবশালী কায়স্থ দত্ত খাঁ'রা ( বর্তমানে দত্ত) অসংখ্য লাঠিয়াল সহ এই স্থানে আক্রমণ করে মুসলিমদের এখান থেকে লাঠি ঠেঙিয়ে বিতাড়িত করলে ডাঙাপাড়া ক্রমে 'ঠেঙাপাড়া ' নামে পরিচিত হয়। পরে পরে মুসলিমদের মুখে স্থানটির নাম প্রচার হয় বে-রেহম-পুর ( বে-রেহমভাবে তাদের মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল) ও ক্রমে বিরাহিমপুরে রূপে জনপ্রিয় হয়। অবস্থাপন্ন কায়স্থরা পরে বিরাহিমপুর নামকে পরিবর্তন করে একবার বিনোদপুর এবং অন্যবার রাধাকৃষ্ণপুর নাম রাখার চেষ্টা করা হয়। বিনোদপুর নাম রাখার প্রসঙ্গে তাদের যুক্তি ছিল কায়স্থ পূর্বপুরুষ গোপালচরণ দত্তের প্রতিষ্ঠা করা কুলদেবতা রাধা-বিনোদ বিগ্রহের নাম অনুযায়ী গ্রামের নাম পরিবর্তন, অন্যদিকে দত্ত বংশের জমিদারপুরুষ শ্রীরাধাকৃষ্ণ দত্ত নিজের নাম অনুযায়ী এই গ্রামের নাম পাল্টাতে চেয়েছিলেন কিন্তু কালের নিরিখে বিরাহিমপুর নামটিই আজও শোভা পাচ্ছে সবক্ষেত্রেই, বাকি দুটি নাম হারিয়ে গ্যাছে। এখানে জেনে রাখা দরকার, এই দত্তবংশীয়দের পূর্ব পুরুষের হাত দিয়েই দিনাজপুরে একদিন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল , যার সাথে যুক্ত ছিলেন প্রভাকর দত্ত। প্রভাকর দত্তের পিতা রবি দত্ত গৌড়েশ্বরের অধীনে সেনানায়ক হিসাবে কাজ করতেন।


                    



বৈষ্ণবধর্মে ডুবে থাকা গ্রামটির অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল শ্রীগোরাঙ্গের পৃথক ভজন ব্যবস্থা, যেটা কাটোয়া মহকুমাতে বাকি স্থানগুলিতে তেমনিভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই গ্রামে বিভিন্নরকম বৈষ্ণব বিগ্রহের পুজো হয়, যেমন সিংহ বংশীয়দের শালগ্রাম শিলা, মিত্র বংশীয়দের রাধাকান্ত জিউ বিগ্রহ, চট্টোপাধ্যায় বংশের রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ এবং দত্ত বংশীয়দের পৃথক নারায়ণ শিলা। এখানে কৃষ্ণ বিগ্রহের পাশে দুই রাধার প্রাধান্য দেখা যায়, যথা শ্রীরাধা ও শ্রীললিতা সখী হিসাবে পূজ্য। এই বিগ্রহটি রাধা-বিনোদ মন্দিরে বর্তমান। বিরাহিমপুরের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সুদৃশ্য টেরাকোটা মন্দিরের গ্রাম।




রাধা-বিনোদ মন্দিরটি হল একটি সুদৃশ্য টেরাকোটা মন্দির। যেটা বঙ্গীয় রীতিকে অনুসরণ করে আটচালা বিশিষ্ট এবং সামনে একটা টিনের ছাউনি দেওয়ার আর একটি চালা। প্রবেশ পথে চাঁদনি নকশা দেওয়া প্রবেশদ্বার। মনে করা হয় ১৭০০ সনের চারের দশকে এটি তৈরি করা হয়েছে, যদিও সময়কাল নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কালের নিরিখে রাধা-বিনোদ মন্দিরের টেরাকোটার কাজগুলো ম্লান হলেও কিছুদিন আগেও আমরা মুগ্ধ হতাম সেই মন্দির চাতালে বসে। অনেকবার মন্দিরটিকে সংস্কার করার দাবিও ওঠে। বর্তমানে টেরাকোটার সুদৃশ্য কাজগুলো আজ অদৃশ্য! মূল্যবান টেরাকোটার কাজগুলির আজ সিমেন্টের ঢালাই করা হয়েছে। ভাবতেও অবাক লাগে বর্তমান প্রজন্ম উদাসিতা নিয়ে, যে মন্দিরকে এককালে কাটোয়া মহকুমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেরাকোটা মন্দির বলে গণ্য করা হতো, তার আজকের চেহারা দেখলে দুঃখ আসে। অনেককাল আগেই মাননীয় বৈষ্ণব গবেষক শ্রীবঙ্কিম চন্দ্র ঘোষ, তার ‘ রাঢ়ের বৈষ্ণব তীর্থ পরিক্রমা ‘ বইয়ে বিরাহিমপুরের রাধা-বিনোদ মন্দির সম্পর্কে লিখেছিলেন –” মন্দিরের গা ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা আগাছাগুলি তুলে ফেলা লোকের অভাব। মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়মিত ঝাড়ু পড়ে বলেও মনে হয় না“। এসব পড়তে স্থানীয় গ্রামবাসী হিসাবে আমাদেরও কষ্ট হয় খুব। যায় হোক, সারাবছরই বৈষ্ণব রীতি মেনে এখানে রাস, দোল, ঝুলনযাত্রার মতো অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমক করেই পালন করা হয় এবং বংশ পরম্পরায় প্রাপ্তবিগ্রহগুলিকে নিত্যসেবা দেওয়া হয়।


কালের হাওয়ার এসব ইতিহাস চাপা পড়ে গেলেও প্রবীণ ব্যক্তিরা আজও রোয়াকে বসে এই ইতিহাসকে রোমন্থন করে, সে রোমন্থনের কথা আমি নিজেও শুনেছি। আমি আজও স্তব্ধ হয়ে ভাবি, চৈতন্যদেবকে স্বপ্ন পেয়ে একদিন এই গ্রামের উপর দিয়েই তো কিশোর কৃষ্ণদাস কবিরাজ ঝামটপুর থেকে বৃন্দাবনের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন......।





আলোকচিত্র -- সম্পর্ক মণ্ডল


নবোঢ়া

 

Courtesy: 'Vermilion Dreams' -- Michelle Keighley


(১)

পাকা-দেখা মাখতে মাখতে
তেল নুন দিয়ে জমাট ব্যাপার
কাঁচা লঙ্কা খুঁজতে গিয়ে
অবেলা হয়ে গেল

রাতে রুটির সঙ্গে খাবার জন্য
সামান্য রেখে দিয়েছ তো?


(২)

বেড়ালটা
বেনারসী ছাড়তে চায় না
কোল ছাড়তে চায় না
লেপ ছাড়তে চায় না

আমারও ইঁদুর ধরতে ইচ্ছে হয় না।

ছায়ারা ইঁদুরের থেকেও দ্রুত পালাতে সক্ষম।


(৩)

মুখেতে কোল্ড ক্রীম
ছাতায় রিমঝিম

কেরোসিন অথবা চার আঙুলের দাগ নেই

সিনেমার গান আছে

আমার সস্তাই ভালো লাগে,
অধমের সংসার, নাম-মাত্র পুঁজি নির্ভর।


(৪)

ব্রোকেন রিব্‌স
ব্রেকিং টাইড্‌স

আহা আহা করতে করতে
ভাঙন শুনে হু হু কর ওঠে

কোনো গোপন সংগঠন
সন্ত্রস্ত প্রেমিকদের সাহায্য করছে না!

হেডফোন পরে দু-চোখ বুঁজে
মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে শুধু।


[চৈত্র, ১৪২৪]


আন্দোলনের বিশ্ব : প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছে সমকাল -- অর্ক ভাদুড়ি

 

উত্তর আয়ারল্যান্ডে সংগঠিত বৃহৎ ধর্মঘট -- চিত্র অর্ক  : ভাদুড়ি  



১৭৫ বছর আগে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন, ইউরোপকে তাড়া করছে কমিউনিজমের ভূত। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বকে ভূত তাড়া করছে ঠিকই, তবে সেই ভূত অতি দক্ষিণপন্থার। কিন্তু সেই ভূত ছাড়ানোর ওঝাও রীতিমতো সক্রিয়। সেই ওঝা হলো গণআন্দোলন।


আগে ভূতের কথা বলা যাক। নেদারল্যান্ডসে হের্ট ভিল্ডার্সের অতি দক্ষিণপন্থি ‘পার্টি ফর ফ্রিডম’ ক্ষমতায় এসেছে। ইতালির বুকে ডানা ঝাপটাচ্ছে মুসোলিনীর উত্তরসূরিরা। দেশের ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী মেলোনির অতি ডান ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’। সঙ্গে জোটসঙ্গী ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার সালভিনির ‘লিগা নর্ড’। দুটিই কট্টর দক্ষিণপন্থি, শরণার্থী বিরোধী দল। জার্মানিতে বিপুল শক্তি বৃদ্ধি করেছে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ (এএফডি)। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে সরকার ফেলার ছক কষছেন অতি ডানপন্থিরা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সেই ‘বিপ্লবের’ খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যাবতীয় ‘অ-জার্মান’ এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষজনকে, এমনকি তারা যদি জার্মানির নাগরিকও হন, দেশ থেকে তাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রকাশ্যে। দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে ‘জার্মানি ফার্স্ট' স্লোগান।


এর মাঝেই ভেঙে গিয়েছে জার্মানির শক্তিশালী বামপন্থি দল ‘ডি লিংকে’ বা লেফট পার্টি। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী সারা ওয়াগেনট্ (Sahra Wagenknecht)

 যিনি সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, নতুন দল তৈরি করেছেন। অবশ্য তাতে শাপে বর হয়েছে। কারণ সারাহ ১৪ শতাংশ ভোট পেতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে সাম্প্রতিক সমীক্ষা। একই সঙ্গে তিনি নিও-নাজি এএফডির ভোট কেটে নিতে পারেন ৪ শতাংশ। কিন্তু সার্বিকভাবে পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।


জার্মানির মতো অতখানি না হলেও স্পেনে শক্তি বাড়ছে অতি ডানপন্থি ‘ভক্স’-এর। হাঙ্গেরিতে ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের অতি দক্ষিণপন্থি ‘ফিদেজ’। পোল্যান্ডে ক্ষমতায় ‘ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’, অস্ট্রিয়ায় ক্ষমতায় ‘ফ্রিডম পার্টি’। প্রতিটিই চরম দক্ষিণপন্থি। ফ্রান্সেও বিপুল শক্তিশালী অতি ডানপন্থি লা পেনের দল ‘ন্যাশনাল র‌্যালি’।


ফ্রান্সের পরিস্থিতি অবশ্য অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। বামপন্থি সাংসদ জাঁ লুক মেলেনকঁর দল ‘লা ফ্রান্স ইনসৌমিসে’, যাকে পশ্চিমের মিডিয়া ‘অতি বামপন্থি’ বলে প্রচার করে, তারাও অত্যন্ত শক্তিশালী। গত নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন একসময় ‘সরাসরি’ কমিউনিস্ট রাজনীতি করা মেলেনকঁ। অতি ডান লা পেনের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ কম ভোট পেয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারেননি। যদি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা লড়ে ৩ শতাংশ ভোট না কেটে নিত, হয়তো ফ্রান্সের রাজনীতি অন্যরকম হতো। ব্রিটেনের জেরেমি করবিন ছাড়া ইউরোপের মেইনস্ট্রিম ‘বামপন্থি’ নেতাদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন মেলেনকঁ। করবিনের মতো ইনিও ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। করবিন এবং মেলেনকঁ দুজনেই সোচ্চারে প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সে জন্য তাদের রীতিমতো মুণ্ডপাত করছে পশ্চিমের মিডিয়া। 


ফ্রান্সে যে কোনো কিছুই হতে পারে। ডান অথবা বাম যে কোনো দিকেই হাঁটতে পারে রাজনীতি। কিন্তু তার বাইরে ইউরোপের অধিকাংশ দেশই এখন দেখছে বিপুল অতি দক্ষিণপন্থি উত্থান। আগামী জুনে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন। সেখানে অতি ডান ব্লকের দারুণ ফলাফলের সম্ভাবনা। ষষ্ঠ স্থান থেকে এক লাফে তৃতীয় স্থানে উঠে আসতে পারে তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন মূলধারার রাজনীতিতে প্রায় অচ্ছুৎ অতি দক্ষিণপন্থিরা এমন জনপ্রিয় হলেন কেমন করে? শরণার্থী সংকট কি তাদের অক্সিজেন দিল? নাকি আরও কিছু কারণ? মধ্য বাম, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা মধ্য ডানপন্থিদের ব্যর্থতাই কি অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের পথ করে দিল? সেই আলোচনা দীর্ঘ। তবে বাস্তবিকই ইউরোপের জন্য ‘এ বড় সুখের সময় নয়'।


পর ব্রিটেনের রাজনীতিতে যে বাম উত্থান হয়েছিল, এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। লেবার পার্টি জিতবে, তবে এই লেবার কয়েক বছর আগের মধ্য বাম অবস্থান থেকে অনেকখানি ডানে সরে গিয়েছে। করবিন ইতিমধ্যেই বহিষ্কৃত। গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত শক্তিশালী, তাদের ভোটও সম্প্রতি বেড়েছে, কিন্তু গোটা দেশের সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে তা বেশ কম। পর্তুগাল, অস্ট্রিয়াতেও কিছু পকেটে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী। রাজধানী ভিয়েনার পর অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গ্রাজের মেয়র একজন কমিউনিস্ট। পর্তুগিজে কমিউনিস্টদের একাধিক সাংসদ আছেন। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে অতি ডানের উত্থান হবে ঠিকই, তবে বামপন্থিদের ফলও খুব খারাপ হবে না। সমস্যা হলো বামেরা বিভিন্ন ব্লকে ভাগ হয়ে আছেন।


কিন্তু এটাই কি একমাত্র ছবি? একেবারেই না। এবার বরং ওঝার কথায় আসা যাক। আসলে ভোট রাজনীতির পাটিগণিতে সবটুকু বিচার করা যাবে না। অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের মাঝেই ভীষণ উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হলো, ইউরোপ জুড়ে শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার বইছে। ব্রিটেনে একের পর এক ধর্মঘট চলছে। জুনিয়র ডাক্তাররা দফায় দফায় ধর্মঘট করছেন। রেল শ্রমিক, লন্ডনের টিউব রেলের কর্মীরা ধর্মঘট করছেন। গত ১৮ জানুয়ারি গোটা উত্তর আয়ারল্যান্ড লাখ লাখ শ্রমিকের ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাকে বলা হলো উত্তর আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধর্মঘট। 

ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সুইডেনে টেসলার শ্রমিকরা বিরাট আন্দোলনে নেমেছেন। সুইডিশ শ্রমিকদের সংহতিতে অন্য দেশের শ্রমিকরাও পথে নামছেন। টেসলার শ্রমিক আন্দোলন ইতিমধ্যেই ইতিহাস তৈরি করছে। ফিনল্যান্ডেও বইছে ধর্মঘটের জোয়ার। জার্মানি এবং ফ্রান্সে কৃষকরা ট্র্যাকটর নিয়ে পথে নেমেছেন। প্যারিসে ঢোকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা মাঝেমধ্যেই অবরোধ করে রাখছেন তারা। এই লেখা যখন লিখছি, ঠিক তখনই আন্দোলনরত কৃষকরা বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করছেন দুস্থ মানুষদের জন্য।


প্যালেস্টাইনের ওপর ইসরায়েলের বীভৎস গণহত্যা গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিসরকেই গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ব্রিটেন উত্তাল হয়ে উঠেছে প্যালেস্টাইনের সংহতিতে। লাখ লাখ মানুষ মিছিল করছেন লন্ডনের রাজপথে। এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর বহুমাত্রিকতা। বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ একযোগে রাস্তায় নামছেন এথনিক ক্লিনজিংয়ের বিরুদ্ধে। প্রান্তিক যৌনতার অধিকারের সাতরঙা পতাকার পাশেই থাকছে বামপন্থিদের লাল পতাকা, একই সঙ্গে মিছিলে হাঁটছেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং জায়নবাদবিরোধী ইহুদিরা। এই আন্দোলন যে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পেরেছে তার প্রমাণ লেবার নেতা, হবু প্রধানমন্ত্রী কের স্টার্মার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যুদ্ধবন্ধের কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। আন্দোলন চলছে স্পেনেও। হাজার হাজার কৃষক কৃষি সংকট সমাধানের দাবিতে রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন এপি-৭ হাইওয়ে। পোল্যান্ডেও চলছে কৃষক আন্দোলন। গ্রেটার পোল্যান্ড গর্ভমেন্ট অফিসের সামনে ইইউ-এর নিশান ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সার্বিয়ায় নির্বাচনী কারচুপির বিরুদ্ধে বিরাট গণআন্দোলন হয়ে গেল সম্প্রতি। গ্রিসেও কমিউনিস্ট এবং বামপন্থিদের নেতৃত্বে নতুন করে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। অ্যাথেন্সের রাস্তায় ব্যারিকেড লড়াই চলছে।


কেবল ইউরোপ নয়, গণআন্দোলনের জোয়ার বইছে অন্য মহাদেশেও। ক্ষমতায় আসার পর দুমাসও কাটেনি, তার মধ্যেই রাজপথের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন আর্জেন্টিনার নবনির্বাচিত অতি-দক্ষিণপন্থি প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই। ক্ষমতায় এসেই আর্জেন্টিনার শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন নিজেকে ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিস্ট’ বলা মিলেই। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ফুঁসে ওঠে জনতা। গত ২৪ জানুয়ারি লাখ লাখ শ্রমিকের ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মেসি-মারাদোনার দেশ। আফ্রিকাও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল। উত্তর কিভুর অশান্তি মোকাবিলায় পশ্চিমা শক্তির মদদপুষ্ট সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে কঙ্গোয় আন্দোলনকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছেন। গুস্তাভো পেট্রোর সমর্থনে হাজার হাজার জনতা পথে নামছেন কলম্বিয়ায়। গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল সেনেগাল। প্রেসিডেন্ট মাকি সল নির্বাচন বাতিল করায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন জনগণ। প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল হেনরির পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলন দমনে অতি সক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে হাইতির পুলিশের বিরুদ্ধে। প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতিতে মিছিলে মিছিলে প্লাবিত মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি দেশের রাজপথ। দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে একদা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুবনেতা জুলিয়াস মালেমার দল, যারা আন্দোলনের শক্তি হিসেবেই পরিচিত। আগামী নির্বাচনে তাদের ডার্ক হর্স বলে চিহ্নিত করছে মিডিয়া।


দক্ষিণ এশিয়া কি এই বিশ্বজোড়া আন্দোলনের স্রোত থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন? এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। শ্রীলঙ্কা মাত্র বছর দেড়েক আগে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সাময়িক পিছু হটার পরে সেখানে নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। ভারতের দক্ষিণপন্থি নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রবল দাপট সত্ত্বেও আবারও কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়েছে। কৃষকরা দিল্লি অভিযান শুরু করেছেন। সরকার ড্রোন থেকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। কৃষকরা ঘুড়ি দিয়ে সেই ড্রোন রুখে দিচ্ছেন। পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল কার্যত এক নীরব ভোট-বিপ্লবের সাক্ষী দিল। সরকার যেই গড়ুন, পাকিস্তানের জনগণ প্রমাণ করলেন, তারা সেনার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে।


একই সঙ্গে অতি দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং গণআন্দোলনের জোয়ার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে চার্লস ডিকেন্সের কালজয়ী উপন্যাস ‘টেল অফ টু সিটিজ’-এর প্রথম লাইন। প্রকৃত অর্থেই এ সময় সবচেয়ে কুৎসিত, আবার একই সঙ্গে অসাধারণ সুন্দর। প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছে সমকাল, গর্ভে অপেক্ষারত নতুন সময়।


লেখক : সাংবাদিক ও স্বাধীন গবেষক। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং গণআন্দোলন নিয়ে কর্মরত।

খোঁজ -- শৈবাল চক্রবর্তী


চিত্রঋণ -- আন্তর্জাল



"Life is a meandering journey and knowing, unknowingly we walk the eternal search for our subconscious - unfulfilled dream.


লোকটা রোজ সজলকে জ্বালাতে আসে। সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাতের শাখা প্রশাখা বিস্তার শুরু হলেই সে আসে। ঘাড়ের উপর এসে নিঃশ্বাস ফেলে অথচ ওকে দেখা যায় না। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বকবক করে। মাথা খারাপ করে ছাড়ে। 

আসলে একটা পার্সেলের খোঁজ নিতে সে আসে। ওটা কাউকে পৌঁছে দেবার কথা ছিল কিন্তু সজল পারেনি। চেষ্টা যে করেনি তেমন নয় কিন্তু একটা পাকাপোক্ত ঠিকানা তো চাই। একটা ছাউনি বলা থাকলে খুঁজে নেওয়া যায় কিন্তু তেমন কিছু না থাকলে… তবু চেষ্টার ত্রুটি করেনি সে। গোড়াতে পার্সেলটায় একটা ঠিকানা ছিল। সেখানে ডেলিভারি করে দিয়েছিল কিন্তু সেই লোকটা তাকে এমনভাবে ধরল… না বলতে পারল না। ডেলিভারির রসিদে সই করে দিয়েই অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় থমকে থমকে লোকটা বলেছিল, “আমার একটা কাজ করে দেবে ভাই? …শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না… পার্সেলটা একজনের হাতে পৌঁছে দিতে হবে… আমার বোন।" সজল অবাক হয়। অদ্ভুত আবদার! লোকটা  থামেনি। ফের বলেছিল, "একটু খুঁজতে হবে হয়ত, অসুবিধা  ও’টুকুই… পারবে?” তারপর হাজার পাঁচেক টাকা আর একটুকরো কাগজ সজলের পকেটে গুঁজে দিয়ে তার ফের কিছু কথা, “কাগজে সব লেখা আছে… সময় সুযোগ মতো কাজটা কোরো, তাড়া নেই…” মরা মাছের মতো চোখ তুলে সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠেছিল, “তুমি পারবে…ঠিক পারবে!”

স্বল্প আয়ের একটা ক্যুরিয়র সার্ভিসের চাকরি।   রাজি হওয়া ছাড়া আর কী বা করার ছিল? সেই যে পার্সেলটা গলায় ঝুলে গেল, আজও তার থেকে রেহাই মিলল না।  কিন্তু আর পারা যাচ্ছে না! আজ হোক বা কাল, যতদিন লাগে…এর একটা বিহিত করতেই হবে! কিছুদিন আগে লোকটার ঠিকানায় সে বলতে গিয়েছিল যে তারপক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয় কিন্তু গিয়ে দেখল দরজায় তালাচাবি। কেউ কিছু বলতে পারল না।  অথচ নিত্যদিন নালীছেঁদা স্বরের এই ঘ্যানঘ্যানানি আর সহ্য হচ্ছে না। তার নিজের তো কোনো বাঁধন নেই আর সে সবের আগুপিছু নিয়ে কোনো আফসোস মনে ঠাঁইও দেয় না। তবু কোনো কোনো দিন সত্যিই খুব একা লাগে। ওই ঘ্যানঘ্যানে স্বরটা  যেন সেইদিনগুলোতে আরও বেশি করে যেন পেয়ে বসে। 

ঘুম আর ঠিকঠাক হবে না তাই খানিকটা রাত বাকি থাকতেই সজল ওঠে, বেরিয়ে পড়ে। ফুরিয়ে আসা রাতের সড়ক ধরে হাঁটতে থাকে। এভাবে লাখো পা হেঁটে অনেক দূর চলে যেতে পারে সে কিন্তু এখন চলেছে রেলস্টেশনের পথে। চটকলপাড়া জুড়ে খুঁজে বেড়াবে একজনকে যার বাম কানের লতির পিছনে তিল, কপালের দু’পাশে ঝুমকোলতার মতো চুল, যে একদিন মোতি নামে এক ছোকরার সাথে ঘর ছেড়েছিল- যার ডাকনাম মনুয়া। এভাবে কি একটা কাঁচাবয়সের মেয়েকে খুঁজে বার করা যায়? এর আগেও তো গেছে তার খোঁজে। বজবজ, উলবেড়িয়া, সাঁকরাইল, ভদ্রেশ্বর, টিটাগড়, কোথায় নয়। আজ যেমন চলেছে কাঁকিনাড়া হয়ে নৈহাটি।  

আবার একটা নিষ্ফলা দিন পার হলো। ভোরের আগে বেরিয়ে সজল যখন হাঁটতে শুরু করেছিল, তখন হাওয়ায় একটা ঠান্ডা, জোলোভাব। যখন ট্রেনে চাপল, তখন মিহি জলকণারা বাতাস ভাসাচ্ছে। তারপর সারাদিন বৃষ্টি; কখনো হাল্কা, কখনো ঘন, অবিরাম একঘেয়ে কান্নার মতো। তারমধ্যে শহরতলির কাঁচা গলিপথ, বস্তির আনাচকানাচ ঘুরে খোঁজ করে যাওয়া, স্যাঁতস্যাতে শরীরটা যেন ঠাণ্ডা মেরে যেতে চায়। গিজগিজে চটকল এলাকাগুলো ঝিমিয়ে ন্যাতা। রাস্তার কুকুর বেড়ালগুলোও নিখোঁজ। 

সারাদিন যা হোক করে একটু চা-বিস্কুট, ঘুঘনি-রুটি পেটে পড়েছে। ভাত পেলে ভালো হতো কিন্তু ঝুপড়ি দোকানগুলোর ঝাঁপ ফেলা। চলার সাথে বেলা গড়ায়। দিনের আলো মরে গিয়ে ক্রমশ মজুরবস্তি, চুল্লুর ঠেক, পাশের বেশ্যাপল্লী আর গৃহস্থের বাসা, সব ব্রাশের একটা রঙের টানে যখন মিলেমিশে একাকার- ধূসর আঁধার, তখনও চলার শেষ নেই। এমন দিনে সন্ধ্যা হয় না। অন্ধকার, নির্জনতা আর ভিজে হাওয়া নিয়ে ঝুপ করে রাত নেমে আসে। 

ডাউন নৈহাটি-শিয়ালদা লোকালটা এবার ছেড়ে যাবে। এটা শেষ গাড়ি নয়, এরপর দুটো, শেষে শান্তিপুর লোকাল আছে। ক্লান্ত শরীরটাকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কামরায় এনে আছড়ে ফেলল সজল। এলিয়ে বসল বটে কিন্তু বসার জায়গাগুলো সব সপসপে ভিজে। ফ্লুরোসেন্টের উজ্জ্বলতায় কামরাতে তখন মাত্র তিনজন যাত্রী। রাত কত কে জানে? সজলের হাতে ঘড়ি নেই। খিদে পেয়ে হারিয়ে গেছে। এবার ট্রেন ছাড়ার জন্য বসে থাকতে থাকতে হারানো খিদে আবার চাগিয়ে উঠতে চাইছে। পকেটে একটা কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট আছে। এটুকুই জোগাড় করতে পেরেছিল। বিস্কুটের প্যাকেটটা বার করে ছিঁড়তে গিয়ে মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। কামরায় তিনটে প্রাণী মধ্যে একজন সে নিজে। আর একজন তার দৃষ্টিপথের প্রায় বাইরে, পার্টিশন দেয়ালের দিকে, মাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ওখানে সম্ভবত জল নেই। আর তৃতীয়জন এক মেয়ে। সামনের দুটো সারি পরে, বন্ধ জানালার ধারে সীটটায় ঈষৎ কোনাচেভাবে বসে আছে। তাই তো! মেয়েটি তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এভাবে একজনের সপাট চাউনির সামনে অচেনা হলেও খাওয়া যায় না। সজল পারল না। অকপট, সোজা দৃষ্টি!  সজলের অস্বস্তি হয়। চোখ নামিয়ে নেয়। প্যাকেটটা ছেঁড়া হয়ে গেছে। কী করবে? মুখ তুলে আড়ষ্টভাবে তাকায়। মেয়েটা হাসে। সজল হাসিটা চেনে। খিদের ভাষা বোঝে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে বিস্কুটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় আর অমনি ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে মেয়েটা খেতে শুরু করে। সামান্য সময় দাঁড়িয়ে সজল তার সীটের দিকে ফিরতেই মেয়েটা মুখ ভরতি বিস্কুট নিয়ে উঁ ঊঁ ঊঁ  আওয়াজ তোলে। পাশে বসতে ইশারা করে। সজলের ইতস্ততঃ ভাব দেখে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়…যেন অনেকদিনের চেনা। গলায় তার বিষ্কুট শুকিয়ে জমে। জলের বোতল বার করে। দু’ঢোক জল খায়। তারপর বিস্কুটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে সজলকে বলে, “খাও… আরে নাও না, তোমারই তো জিনিস!” সজল চুপচাপ দুটো বিস্কুট তুলে নেয়। মেয়েটা জলের বোতলটাও এগিয়ে দেয়। এইসব কিছুর ফাঁকে ট্রেনটা নড়েচড়ে ওঠে। গন্তব্যে রওনা হয়ে যায়।

মেয়েটিকে দেখে সজল ভাবে, যে মনুয়াকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ’ যদি সেই মেয়ে হয়, তাহলে কী ভালোই না হয়। এমন অবাককাণ্ড কতই তো হয়। এরও কাঁচা বয়েস। ছিপছিপে ধারালো চেহারা, যেমনটা নাকি মনুয়ার ছিল। ওর হাল্কা খয়েরি চোখ, কপালের দু’পাশে ঝুমকোলতার মতো কোঁকড়ানো চুল, ঈষৎ ফোলানো ঠোঁটের সাথে মনুয়ার কতটা মিল? ওর বাম কানের লতির পিছনে তিলটা আছে কি? 

ট্রেনটা দুটো স্টেশন পার হয়ে যায়। কেউ ওঠে না। দুর্যোগ ঘাড়ে নিয়ে এত রাতে জরুরি কারণ ছাড়া কেউ বেরুবে না, এটা জানা কথা। সজল ভাবে এবার সে কী করবে? 

“এই যে, থ্যাংকু!” মেয়েটা হাসছে। হাসিটা এখন উজ্জ্বল। সেও হাসার চেষ্টা করে। বাইরে হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট বাড়ে। জানালা বন্ধ কিন্তু লোকাল  ট্রেনের আংশিক খোলা দরজা দিয়ে কাঁপন ধরানো হাওয়া ভিতরে এসে সশব্দে দাপাদাপি করতে থাকে। 

মেয়েটা আবার বলে, “সত্যি খুব খিদে পেয়েছিল।” সজল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে- চোখ আর গাল হাল্কা বসা, সিঁথির গোড়ায় কাটা চিহ্ন… সিঁদুরে দিব্বি ঢেকে যাবে আর কপালে কাচপোকা টিপ। 

উত্তরে বলে, “আমারও পেয়েছিল।”

 “তোমার কাছে আর কিছু নেই?”

সজল ডান পকেটে হাত গলিয়ে কেকটা বার করে আনে। চাপে খানিক চটকে গেছে। মেয়েটার চোখে আলো। হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেয়। খুলে মুঠোয় ডেলা করে খানিকটা, বাকিটা ফেরত দিয়ে খেয়ে নেবার ইশারা করে। গাড়ি ছোটে। সজল ভাবে, নাম জিজ্ঞাসা করলে গায়ে পড়া ভাবতে পারে কিন্তু ওর নাম মনুয়া যদি হয়! 

মেয়েটা বলে ওঠে, “তুমি খেলে না?”

সজল মাথা নাড়ে, “নাহ, বিস্কুটে হয়ে গেছে… তুমি নাও।”

মেয়েটা নিঃসংকোচে হাত বাড়ায়। কিসমিসের দুটো টুকরো আলাদা করে তুলে নিয়ে চোখ বুজে খায়। সজল দেখে। কটকটে বেগুনী রঙের সিন্থেটিক সস্তার শাড়ি, কমলা রঙের ছোটো হাতা ব্লাউজ, হাতে প্লাস্টিকের চুড়ি, পায়ে রাবারের চটি, একটা শাড়ি দিয়ে বানানো ঝোলা কিংবা বোঁচকাও বলা যায়, সাথে নিয়ে এই মেয়ে এমন দুর্যোগে একা একা কোথায় চলেছে? ভাবনাগুলো ইতিউতি ছোটাছুটি করে। ট্রেনও তার গতিপথে ছুটতে থাকে স্টেশন ছাড়িয়ে আরেক স্টেশনে।

“তোমার নাম কী?”

সজল প্রথমে খেয়াল করেনি। ট্রেনের আওয়াজ আর ভাবনায় আটকে ছিল। মেয়েটি ওর হাঁটুতে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দেয়।

“নাম?”

““আমি সজল। তুমি?”

“মনুয়া।! ওই নৈহাটি চটকল বস্তি আছে না? পাশেই থাকি।”

“তুমি মনুয়া!” সজল হাঁ করে থাকে। “তোমার নাম মনুয়া?  ঠিক বলছ?” একটু সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে।

“অজীব লোক তো! নিজের নাম ভুল বলব? এত্ত অবাক হবার কী আছে? এই! …চেনো নাকি আমায়? এসেছ আমার কাছে আগে… ওই চটকল লাইনে?” একটু ডানদিকে, সজলের কাছের দিকে ঝুঁকে মেয়েটা কথাগুলো বলে। ট্রেনের শব্দ, হাওয়ার শব্দ এড়িয়ে শুনবে, শোনাবে বলে। 

সজলের অপ্রস্তুত লাগে, “নাহ আমি এক মনুয়ার কথা জানি তাকে খুঁজছি।”

“হাহ! সেই ভাবি, তুমি লোকটা একটু অন্য টাইপ আছো। সহী বাত! তুমি আমায় চিনবে কী করে?”

সজল কথা বলে না।

 “এ’ মনুয়া তোমার কে? গালফেরেণ্ড?”

এবার সজল না বোঝাতে মাথা নাড়ে। ভাবে মেয়েটাকে মোতির কথা জিজ্ঞাসা করবে কিনা। ও চটকল লাইনের কথা বলছিল না? মোতি তো চটকলে কাজ করত। মোতির সাথেই তো মনুয়া পালিয়েছিল। ফ্যাসফ্যাসে গলার লোকটা চিরকুটে মোতির কথা লিখে রেখেছে। মনস্থির করে উত্তর দেয়, “না না, সেসব কিছু না। কোনো মনুয়াকে আমি চিনি না। একজন দায়িত্ব দিয়েছে, ওকে খুঁজে একটা পার্সেল দেবার জন্য।” একটু থমকায় সজল, তারপর বলে, “তুমি কি মোতি বলে কাউকে চেনো?”

“আহ! এ’ মোতিটা আবার কে?”

“এই মোতির সাথে মনুয়া পালিয়েছিল। আমি অনেক  খুঁজেছি, পাইনি। আজ অন্তত মনুয়া নামে কাউকে পেলাম।” সজল ম্লান হাসে।

“অচ্ছা, তো ইয়ে হ্যায় স্টোরি! … হাঁ, মিল তো আছে। আমিও একজনের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম… কিন্তু সে হারামি কোনো চটকলে কাজ করত না। ওর নাম মোতি  না।”

এই মেয়েটা সেই মনুয়া হতে পারে, নাও হতে পারে কিন্তু সজলের ওর ব্যাপার কেমন ধাঁধার মতো লাগে।

“আমি সেই মনুয়া? তোমার কী লাগছে?”

“জানি না!”

“অচ্ছা কী আছে পার্সেলে?”

“তাও জানি না।”

“তোমার কী লাভ?”

“কুরিয়ার ডেলিভারি করি। এক ক্লায়েন্টকে পার্সেলটা দিতে গেছিলাম। অনেক করে বলল তার বোনের হাতে পৌঁছে দিতে। কথা দিয়ে ফেলেছি।  কিছু টাকাও  দিয়েছে।”

“আরে বাহ! তাহলে এখন কী করবে?”

“তোমার কোনো দাদা আছে?”

“আছে।“

“সে কোথায় থাকে…কী করে… মানে…”

মেয়েটা মাথা নাড়ে। “জানি না! পাঁচ বছর আগে ঘর ছেড়েছি। শুয়োরের বাচ্চাটা আমাকে চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছে! আমি ভাড়া খাটি আর ও পা নাচিয়ে হারামের পয়সায় খায়। ছোড়ো! এসব কথা শুনে কোনো লাভ নেই।”

“এই ঝড়জলের রাতে তুমি কী তাহলে…”

মেয়েটা বিষন্ন হাসে, “হাঁ গো জলবাবু, আমি পালাচ্ছি! যার সাথে পালিয়ে ছিলাম, তার থেকে পালাচ্ছি। আগেও চেষ্টা করেছি। হারামির বাচ্চাটা ঠিক ধরে এনেছে। চোরের মার দিয়েছে… এই দেখো!” সিঁথির কাটা দাগ দেখায়। “যার সিঁদুর দেবার কথা ছিল, বোতল দিয়ে…তবে মাল খেয়ে ছিল, ঠিক মতো মারতে পারেনি, হাল্কার উপর গেছে। আমিও শ্লা মেরেছি তলপেটে এক লাথি! ফেলাট একেবারে!” এক নি:শ্বাসে কথা বলে মেয়েটা হাঁফায়। চোখ ধ্বকধ্বক জ্বলে।

এরপর ওরা চুপ। ট্রেন চলার ধাতব আওয়াজ ওঠে শুধু। 

"কোথায় যাবে?" সজল একটু সহজ হবার চেষ্টা করে।

সজলের দিকে না তাকিয়েই মেয়ে মাথা নাড়ে। 

"শিয়ালদা পর্যন্ত না আগেই…?" সজল ফের জিজ্ঞাসা করে।

"জানি না! পালাতে পেরেছি, এটাই অনেক। লাস্ট স্টেশনে যাই, ফির দেখা যাবে।"

সজল অবাক হয় না। অনিশ্চিত জীবন মানুষকে কতটা বেপরোয়া করে তোলে, সে জানে। আরও অনিশ্চিতে ঝাঁপ দেওয়াটা একধরনের জুয়া খেলার মতো। এক-আধজনের বাজিমাত হয় ঠিকই কিন্তু  বাকিদের জন্য অপেক্ষা করে ঘেয়ো-কুকুরের জীবন। 

মেয়েটা তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে। সেখানে আলো আর অন্ধকারের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা কিন্তু ওর মনের অন্ধকারে একটাই রঙ।

ওরা আবার কথা বলে। সে সব কথা ভিজে হাওয়ায় আরও নরম হয়ে যায়। সে কথা মামুলি হয়ত, কিছু বা জরুরি, কিছু কখনও কোথাও অব্যক্ত ছিল, কিছু কথা বলি বলি করে অনুচ্চারিতই থাকে। ওরা আবার চুপ করে। ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে যায়। মনুয়াকে খুঁজে পাওয়া গেলো কিনা সেটা এখন যতটা সজলকে দোলায়, তার চেয়ে বেশি ভাবায় মেয়েটার অনিশ্চয়তার কথা।

রাত কত, শিয়ালদা স্টেশনের ঘড়িতে দেখে না সজল। মনের ভিতর তার কাটাকুটি খেলা। দ্রুত পা চালায় আর মেয়েটাও পায়ে পায়ে এগোয় তার সাথে। স্টেশনের ভিতরটা ফাঁকা কিন্তু কংক্রিটের গাঁথনি, ছাদ, থাম, ডিসপ্লে-বোর্ড, আলো আর বিজ্ঞাপনের বাহার নির্জনতাকে কিছুটা সরিয়ে রাখে কিন্তু বাইরেটা তো তেমন নয়। খোলা আকাশ, ভাসতে থাকা গুঁড়ো জলের কণা আর সার দিয়ে ঝাঁপ ফেলা দোকান, সাথে বাড়ির বন্ধ দরজা-জানালা, নির্জনতা ছড়ায় পথের আঁকেবাঁকে। হাওয়া চলার শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। ওরাও কেউ কথা বলে না। বৈঠকখানা বাজারের রাস্তা ধরে সজল এগোয়। দিনেরবেলা মানুষের গা বাঁচিয়ে চলা যে পথে  মুশকিল, এই ভেজা ভারি রাতে সেই পথ তখন কল্পনাতীত নি:স্ব।

বাঁদিক ডানদিক পথ ঘুরে, টানা সোজা রাস্তা ধরে যখন একটা হাসপাতালকে ছাড়িয়ে ওরা আড়াআড়ি বড় রাস্তা পার হয়ে গলিপথে ঢোকে, তখন সজল কথা বলে।

"আমরা প্রায় এসে গেছি।" 

"রাতটুকু নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে! বাইরে কোথাও পড়ে থাকলে কোনো হারামী এসে মাগনায় গায়ে হাত দিয়ে দিত!" মেয়েটা হাসে।

এবার যে গলিপথ বেয়ে ওদের চলা, প্রতিনিয়ত অন্তহীন মানুষের সেই পথে চলাচল। অসংখ্য সন্দিগ্ধ চোখের কৌতূহলী দৃষ্টির এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি আর দ্রুত পায়ে এলাকা পেরিয়ে যাবার প্রবণতা। সেকেলে বাড়ির নীচে সার দিয়ে দোকান, অবিরাম সাইকেল, স্কুটার, রিকশা আর মানুষের ছোটাছুটি। বাড়তে থাকা গয়নার কারবার জড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়া এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধ। সন্ধ্যা নামলে, আনাগোনা করা লোকজনের চেহারা এখানে পালটাতে থাকে। তখন অন্য গন্ধ, অন্য রূপ; দরজায় দরজায় লাস্যময়ী আহ্বান। রাত যত গড়ায় তত ঘন হয় মজলিস, বিবিধ গন্ধের মিশ্রণে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস।

আজ এমন একটা রাত, এ'পথও শুনশান।  কিন্তু যারা অপেক্ষা করে, তাদের ক’জন এখনও দরজার আড়ালে কিম্বা জানালায় বসে। সজলদের দেখে কৌতূহলে কেউ কেউ আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আর ঠিক তখনই মেয়েটার গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে সজলের কানে বাজে, "এ কোথায় আনলে জলবাবু!" 

ওই প্রতিক্রিয়ায় সজল হকচকিয়ে যায় কিন্তু সামলে নেয়। "সব ঠিক আছে মনুয়া, ঘাবড়িও না,  চলে এসো… আমি…আমি  এ'পাড়াতেই থাকি।" 

কিন্তু মেয়েটা তখন ফুঁসছে- "নাহ! মরদ জাতটাই হারামি! তুমিও শ্লা একটা দালাল…তোমায় চিনতে বড় ভুল হয়ে গেছে!" ওই আলো আঁধারিতেও বোঝা যায়, মেয়েটার চোখজোড়া জ্বলছে।

যারা আড়াল ছেড়ে কাছে এগিয়ে এলো, ওদের তখন ভারি কৌতুহল। ওরা সজলকে চেনে। কারও রাগ বা অভিমান আছে ওর ওপর, কারও দুর্বলতা, কারও বা  মায়া, কারও স্নেহ। ওরা কেউ চায় রগড় দেখতে, কেউ চায় বুঝতে আর কেউ বা বুঝিয়ে সুজিয়ে সজলদের ঘরে পাঠাতে। এই বোঝাবুঝি পর্ব অবশেষে মিটলে সজল মেয়েটাকে নিয়ে তার বাসায় গেলো। বাসা মানে মাঝ উঠোনের চারদিক ঘেরা, পুরনো তিনবাড়ির নিচতলায়, বারো-দশ মাপের একটা ঘর।

"খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম"

"জানি"

"এমন একটা জায়গায় তোমার বাসা হবে…ভাবতে পারিনি।”

সজল হাসে, "বাপ কে ছিল জানি না তবে আমার মা এই ঘরে ভাড়া থাকত, ভাড়া খাটত! অকালে মরে যাবার পর এখন এই বাসাটুকু আছে।"

মেয়েটা মাথা নামিয়ে নেয়। সজল বলতে থাকে, "তুমি ঠিক ভেবেছ। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। এখানে আমার মতো ছেলেরা হয় দালাল হয় নয় মস্তান কিম্বা দুটোই। আমি এই নিয়মের বাইরে গেলাম কিভাবে, জানি না। মা মরতে এরাই সব আমায় আগলে রেখেছে আর এই ঘরটার একটা টান! কেমন যেন শিকড় জন্মে গেছে।"

রাত আরও খানিক গড়িয়ে যায়। ঘরের শুকনো খাবার আর চৌকিতে পিঠটাকে টান করতে পারা, দুটোই ওদের কাছে বড়সড় প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। কী অদ্ভুত! দু'জন অপরিচিত মানুষ, জীবনের আলাদা অভিকর্ষে যাদের যাপন, আজ একই বৃত্তে এসে পরিক্রমা করতে চায়। ওদের চোখে তাই ঘুম নেই কিন্তু মুখে কথা আছে। এই সময়ের ব্যপ্তিটুকু যে নির্দিষ্ট, সেটা ওরা হয়ত বুঝতে পারে।

"তুমি শেষপর্যন্ত কোথায় যাবে ভেবেছ?"

"হুঁউ"

"কোথায়?"

"সোনাগাছি"

লাফিয়ে উঠে বসে সজল। থমকায়। অসহিষ্ণু ভাবে জিজ্ঞেস করে "তাই যদি যাবে, এখানে অমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন?"

মেয়েটা ফোঁস করে ওঠে, "আমি কোথায় যাবো, কী করব, সেটা আমার ইচ্ছে। অন্য কেউ সেটা ঠিক করবে নাকি?"

সজল বিড়বিড় করে, "নরক থেকে পালিয়ে নরকে যাবে?"

মেয়েটা এ'কথায় ভারি মজা পেল। একটু জোরেই হেসে উঠল- "এই শোয়াটুকু ছাড়া আর কিছুই পারি না গো। তবে এবার ভালোমন্দ যা কিছু, সব নিজের ইচ্ছেমত করতে চাই!

সজল চুপ করে থাকে। কী আর বলা যায়! 

"ফিল্মি ভেবে লাভ নেই গো জলবাবু। ওই চটকল লাইনে…সব শিয়াল কুকুরের মতো মুখ দিত। তার চেয়ে এটা ভালো। ওখানে আমার চেনা লোক আছে। ব্যবস্থা করে দেবে।" মেয়েটা বলতেই থাকে। ওর কেমন জোশ এসে গেছে। শরীরের উপর নিজের অধিকার নিয়ে, আপন শর্তে ভালো থাকা নিয়ে অঝোরে কথা বলতে থাকে। কিন্তু সজল আর শুনতে চায় না। মেয়েটা কি বোঝে না, শরীরের পুঁজিটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। বিয়োগের খেলা শুরু হবার আগেই সব যোগ সেরে ফেলতে পারে ক’'জন? ও কি পারবে?

রাতের অবশিষ্টটুকু ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসতে থাকে। 

 সকালে এখন শুধু মেঘের সামিয়ানা। বৃষ্টি থেমে আছে। থমকে আছে সজল, নৈহাটির বেশ্যালয় থেকে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট হয়ে সোনাগাছি পর্যন্ত একটা ত্রিভুজের ঠিক মাঝখানে। এই মুহূর্তের সত্যিটা হলো ওরা দু'জনেই আবার পথে। আর একটু বাকি। তারপর মেয়েটি যে পথে যাবে, সজল ফিরবে তার বিপরীতে।

"আসি তাহলে?"

"সাবধানে যেও…"

"হুঁউ"

"যাহ!  ভুল হয়ে গেল!"

"কী হলো?"

"পার্সেলটা দেওয়া হলো না যে!"

"থাক ওটা! মনুয়াকে খোঁজাটা চলবে তাহলে।"

"আর খুঁজব না!"

"কেন? সেভাবে খুঁজলে  ভগওয়ানকেও পাওয়া যায়।"

"থাক!"

"হাল ছেড়ো না জলবাবু। কোনোদিন এভাবেই…  আমাদের দেখা হয়ে যাবে।"

মেয়েটাকে বাসে তুলে দেয় সজল। ধীরে হাত নাড়ে। বিনবিন করে কানের কাছে বাজে- “...দেখা হয়ে যাবে”। বাসের চাকা গড়ায়। দু'টি বৃত্তের মিশে যাওয়া আবর্তে চ্যুতিরেখা দৃশ্যমান হয়। সজলের আর জানা হয় না, মেয়েটার বাম কানের লতির পিছনে তিল আছে কিনা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বোঝা হয়ে যায়, খোঁজাটাই তার কাজ। সেটাকে জারি রাখতে হবে।


['বৈঠকী কলম' এর ১৪৩০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত ]




ঔরঙ্গজেব সিরিজের কবিতাগুচ্ছ

   
 Summer Night by the Beach : Edvard Munch



ঔরঙ্গজেব - ১


আক্রান্ত বলেই হয়ত, এইভাবে

           পরাক্রম শান দিয়ে যাই

ক্ষতগুলোই পাথর, অমসৃণ নদীতট

ঘষে ঘষে ধারালো হয়--

ছায়ানট

সম্মুখে আরও ক'টা ধাপ;

কিস্‌মৎ।


আক্রান্ত বলেই হয়ত

       হাঁত কাপে না, যেমন কাঁপত আগে।

ছুটতে ছুটতে সেই

প্রান্তর থেকে অনেকটা দূরে চলে যাই

বিস্মৃত হই, সরে সরে সেই গিরি কন্দরে

              শরনার্থী শিবির আমার নয়।


পাঁজরে খোঁচা দেয় নিজেরই খোলা তলোয়ার

আত্মসমর্পণ করো-- নিঃশর্ত

আমি নিঃশর্তকে নিঃস্বার্থ শুনি বার বার

হাসি... আরও সশব্দে হাসি।





ঔরঙ্গজেব - ২


বর্মটা নিরেট ইস্পাত

কিংবা কালো পাথরের মতই দেখায়

নিরাপদ দূরত্ব থেকে

দীর্ঘ ব্যবধানের অসদ স্পর্শ

তা কি যথেষ্ট হতে পারে?


কাঁটার ফলাগুলো ভেতরেও বিঁধে বিঁধে থাকে।

ক্ষতদান, তাকেও যে শিল্প

জেনেছি 

একাধিক  যুদ্ধে, সে রণনীতি অন্যরকম

আজও ক্লান্ত হয়ে ক্ষতগুলোকে দেখতে দেখতে

পাশ ফিরে চোখ বুঁজি

ক্ষতগুলো সারা রাত চোখ মেলে দেখে। 







ঔরঙ্গজেব - ৩ 


জাফরির এপার থেকেই

সূর্য দেখতে শিখেছি দু'বেলা 


নতজানু হয়ে 

নিয়মের প্রার্থনাকাল

আমার বন্ধ চোখ, বিহ্বল হাত দু'টো 

দেখো 


মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়তা, যে মুহূর্তে শিথীল

সেই মুহূর্ত তোমার 

বাকি উপশিরায় স্রোত, লবনাক্ত

সে ভাবেই চিনে নিক লোকে

যেইভাবে চিনেছে কৃপাণ


রাত-রেখা উত্তাল হাওয়া 

রেত শিরশির 

বঞ্জর জমিন ছুঁয়ে যাওয়া আঁধির মতো

যেমন দেখেছি তাঁবুতে তাঁবুতে

যেমন কেঁপেছি শৈত্যে

বর্মটা খুলে রেখে পাশে

ক্রমশ সে কাঁপুনিও

ঘুমিয়েছে হয়ে অচেতন,

অসম যুদ্ধের পর; আমারই মতন


আবার সেই, 

রোদ্দুর মাখব বলেই আঁকড়ে থেকেছি

দু মু'ঠো বালি

সূর্য দেখেছি রোজ 

ঈশায় ফজরে 

সূর্য দেখেছি রোজ

দাহগ্রস্ত দুর্গের ছাদে 

চোখের সে জ্বালাতেই 

তুমি আছো জেনে

পলক ফেলিনি কোনওদিন।


[পৌষ, ১৪২০]





বান্ধবী সিরিজের কবিতাগুচ্ছ




Painting -- Edvard Munch





বান্ধবী ১

একটা পাসওয়ার্ড দখলের পর
ঝাঁপিয়ে পড়বে মুছে ফেলতে!
মুছেই চলবে রোজ—
রেসের ঘোড়ার মত দাঁত বের করে
হাঁফাতে হাঁফাতে মুছতে চাইবে
ভয়ের টুকরোগুলো।
কৃপণ বৃদ্ধের মত সন্দেহের চোখে
দেখবে প্রতিটা গোলাপের পাপড়ি।

অথচ নাগালের বাইরেও কত পাসওয়ার্ড
ঘুড়ি হয়ে আছে
উড়ছে, ভাসছে, দুলছে—
আকাশে, তারে, গাছের ডালে।

ওড়ার স্বাদ পেলে,
পাসওয়ার্ডও আর তুচ্ছ থাকে না।





বান্ধবী ২

কখনও ছাদ, কখনও বারান্দা;
হয়ত এমনই আরও অনেক কিছুর—
তিন ভাগ জল।
এও এক পৃথিবী চেনা!

শিশুর বিস্ময় আর বালিকার কৌতূহল;
দুলেছি ক্যালেন্ডারের মত।
খোলা জানলা, আর সিলিং ফ্যান
না থাকলে যে কী হত!

তারপর, কী ঠিক করলে?
অবশিষ্ট এক ভাগ—
সবটুকুই কি রুপোর সিঁদুর কৌটো হয়ে যাবে?






বান্ধবী ৩

নীল কাগজ,
খাম
অথবা কালি
এভাবেই ঈথার সমুদ্রে আসা যাওয়া।

প্রিয় ফুল অথবা রঙের প্রসঙ্গ ছাপিয়ে
বাড়ানো আঙুল, পেল নিমগ্ন চোখ।

খুচরো মুহূর্ত বিলিয়ে দাও—
বহুবর্ণ জল, ঢালো অসম পাত্রে।
অনুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখে রাখো—
একটা গভীর 'হয়ত'র ভেতর ডুবে যাক
আমার খামোখা আঁকিবুঁকি।

উদাসীন
প্রতিটা বীতশোক মেঘ—
তোমাকে দেখাল শুষ্ক পল্লব,
আর আমাকে ছোঁয়াল নিম শিশির।






বান্ধবী ৪

মায়াজাল
বাসন্তী অথবা কাঁচা হলুদ;
এটুকুই এনেছিল খিলখিল স্রোত
তার ওপর মায়াকাজল...
তিন ধাপের দীঘিও যে কত গভীর
গলা না জড়ালে
বিশ্বাসই হ'ত না কোনও দিন!

শ্যাওলা ধরা সিমেন্ট খসতে খসতে
তিনটে ধাপই মুছে গেল।
ফ্ল্যাট দেখতে আসা তোমার কাছের মানুষ
জানলই না—
তোমারই সেই ডুবতে চাওয়া নূপুর
ভিতের নীচে এখনো অপেক্ষায় আছে।






বান্ধবী ৫

একটা কাচের বয়াম ভাঙার স্মৃতি
আচারের মতই রোদে শুকিয়েছিল
অনেকগুলো দুপুর।
কারও জিভ ছোঁয়ার আগেই
ফেলে দিতে হ'ল;
কাচগুঁড়ো মিশেছিল, স্মৃতির শিরায়।
আপন ভালো বোঝা পাগল
অতটাও আপন ভোলা হবে কী করে?

ঘুমচোখে অবহেলা রোদ
স্বপ্নের কাচগুঁড়ো কড়কড় করে।
আর কিছু শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মৃতদেহ
ঝাঁট দিতে দিতে তুমি ভাবো—
এরাও কি জিভ ছুঁতে চেয়েছিল কোনওদিন...
আমারই মতন?

বেঁধা কাচ পিঠে নিয়ে
চিৎ হয়ে শুতে নেই সাজানো খাঁচায়,
ভালো থাকা, তুমি এভাবেই পাশ ফিরে শোও।




[মাঘ, ১৪২৫]




নির্বাচিত লেখা

প্রিমিয়াম — জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

  ব্লে ডের অভ্যেসটা অনেকদিন হল কেটে গেছে। দাঁত দিয়েই কাজ চলে যায়— যেভাবে মুহূর্তও চলে যায়, টিক টিক শব্দ শোনা যাক বা না যাক। তবু, মাসে অন্ততঃ...

বহু পঠিত লেখাগুলি