চিত্রঋণ -- আন্তর্জাল |
'দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ' -- এই প্রবাদটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। রাক্ষস-রাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র সেই হরি-ভক্ত প্রহ্লাদ... যাকে চরম সংকটে রক্ষা করতে নরসিংহ অবতার রূপে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন। বধ করে পাপ-জন্ম থেকে মুক্তি দেন হিরণ্যকশিপুকে। সেরকম রামায়ণেও দৈত্যকুলে এক রাম-ভক্ত ছিল... তরণীসেন। যদিও, তরণীসেনের চরিত্র বা পরিণতি প্রহ্লাদের মতো নয়। বরং উল্টোই। সত্যি বলতে... তরণীসেনকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা চারিত্রিক বিশ্লেষণের অবকাশও নেই। বিভীষণ এবং সরমার পুত্র তরণীসেন একেবারেই বাঙালীর নিজস্ব। কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কা কাণ্ডে যে তরণীসেন বধের অধ্যায়... তা বাল্মিকী রামায়ণে নেই। বাল্মিকী রামায়ণে তরণীসেন চরিত্রটিই নেই!
পর পর দু'জন রাক্ষস সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর নিকষার তৃতীয় সন্তানটিও হয়ত রাক্ষস-মতি হবে বলেই প্রত্যাশা করেছিল দৈত্যকুলের সকলে। কিন্তু বিভীষণ পেয়ে গেল পিতা বিশ্রবার জেনেটিক ট্রেট... ধার্মিক মতি। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ যেমন ব্যতিক্রম, তেমনই ব্যতিক্রম বিভীষণ। বেদজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞ দশাননও ছিল। গুণ এবন জ্ঞান তারও কম নয়। কিন্তু বিভীষণ রাক্ষস হয়েও ছিল নেকড়ের পালে ভেড়ার মত। তবে সে জ্ঞানী, বিচক্ষণ... চুপচাপ অনেক কিছুই দেখত, বুঝত... যেন অপেক্ষা করত উপযুক্ত মুহূর্তের। রাবণকে প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে সেই উপযুক্ত মুহূর্ত এলো... নিজের পথে চলার পরিকল্পনা নিল বিভীষণ। রাবণ যে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই অপমানও ভুলেছিল বলে মনে হয় না। তারপর কী কী করল, মোটামুটি সবাই জানি।
এই বিভীষণেরই পুত্র তরণীসেন। দৈত্যকুলেরই একজন, কিন্তু বাপ-ঠাকুর্দার মতো সাত্ত্বিক, ধার্মিক... এবং রাম-ভক্ত। অথচ তার কর্তব্য-নিষ্ঠা একেবারে অন্যরকম। বিভীষণ রাবণের শিবির ত্যাগ করে চলে গেল রামের দিকে। তরণীসেন গেল না। রাবণ যখন বিভীষণকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছে, বিভীষণ রামকে লঙ্কার বিরুদ্ধে মন্ত্রণা দিচ্ছে... সেই কথা বলছে; তরণীসেন সেই প্রসঙ্গেও গেল না। বলল -- পিতার ব্যাপারে আলোচনা করা উচিৎ না। মা সরমাকে বলল -- আমি জানি শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার, যদি দাসের সন্তান বলে না মারেন, তাহলে ফিরব... না হলে বৈকুন্ঠলোকে স্থান হবে। তরণীসেন যুদ্ধ করল রামের বিরুদ্ধে, রাক্ষস সেনা নিয়ে এগিয়ে গেল... গঙ্গা-মাটি দিয়ে পতাকায় আর রথের সর্বাঙ্গে রাম-নাম লিখে!
কৃত্তিবাসের সৃষ্টি এক অদ্ভুত ট্র্যাজিক নায়ক তরণীসেন। স্বল্প উপস্থিতি... অথচ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তিন প্রহর যুদ্ধের পর রাক্ষস যোদ্ধা মকরাক্ষ বীরগতি প্রাপ্ত হল। ঠিক তখনই কৃত্তিবাস জন্ম দিলেন তরণীসেন চরিত্রের। লঙ্কাকাণ্ডের এক ছোট্ট অধ্যায় -- তরণীসেনের যুদ্ধ ও পতন। অবতার শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই সে গেল সমরে। রাম-লক্ষণ ও পিতা বিভীষণের দর্শন করবে... এই উদ্দেশ্য। যুদ্ধ প্রান্তরে প্রবেশ করেই খুঁজতে লাগল... তারা কোথায়। এক এক করে বানর যোদ্ধাদের পরাস্ত করে যখন রামকে দেখতে পেল, তখন প্রণাম করে স্তুতি করতে শুরু করল তাঁর। শ্রীরাম বিভীষণকে জিজ্ঞেস করলেন -- "শত্রুপক্ষে এ কে যে আমার স্তুতি করে?... আমাদের কেন প্রণাম করে?" বিভীষণ নিজের পুত্র-পরিচয় গোপন রেখে বলল, রাবণের জ্ঞাতি... ভাইয়ের ছেলে; ধার্মিক যোদ্ধাপতি। জানাল --
"প্রভু, না জান কারণ!
লঙ্কাপুরে ও তোমার ভক্ত এক জন।।
তোমার চরণ বিনা অন্য নাহি জানে ।
আসিয়াছে সংগ্রামেতে রাজার শাসনে।।"
ঠিক এইখানেই 'দৈত্যকুলে তরনীসেন'-এর চরিত্র খোদাই করে দিয়েছেন কৃত্তিবাস। পাঠকের কল্পনায় ফুটে উঠবে বিভীষণের অতীত, এবং তার পুত্র হিসেবে তরণীসেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
তখনই হয়ত পরিস্থিতি সামলে নেওয়া যেত। আসন্ন অঘটন এড়ানো যেত। কিন্তু তা ঘটল না। তরণীও আক্রমণ করল, রামচন্দ্রও সবাইকে থামিয়ে বিভীষণকে চেপে ধরে বললেন না "ব্যাপারটা খোলসা করে বল তো?" কিন্তু এ তো কৃত্তিবাসের নিজস্ব সৃষ্টি! উনি তরণীকে বিভীষণের পাশে দাঁড় করালেন না। তরণীসেন একই সঙ্গে ধার্মিক এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। সে লড়ে গেল শ্রীরামের সেনার বিপক্ষে। এক এক করে সকলে এল, কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারল না। রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঝেই তাঁর মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শন করল তরণীসেন! শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করতে বসল অস্ত্র ত্যাগ করে। সেই বন্দনাও কৃত্তিবাসের এক সচেতন প্রয়াস, যা শুনে রাম চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছেন "লঙ্কায় এমন ভক্ত আছে? এই লঙ্কা আক্রমণ করে কী হবে? কীভাবে বধ করব এমন ভক্তদের?" একটি কনট্রাস্টের কী চমৎকার দৃশ্যায়ন। মহাভারতে অর্জুন এই দ্বিধাতেই অস্ত্র তুলতে পারছেন না, শ্রীকৃষ্ণ গীতা উপদেশ দিচ্ছেন। বিশ্বরূপ দর্শন করাচ্ছেন অর্জুনকে। আর এখানে তরণীসেন বিশ্বরূপ দর্শন করছে, তার বন্দনা শুনে অবতার স্বয়ং বলছেন "কী করব যুদ্ধ করে? কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলছি?"
যুদ্ধ ত্যাগ করে বনে ফিরে যেতে চাইছেন শ্রীরাম, এই অঘটন দেখে তরণীসেন আবার তাদের উসকে দিল সীতার উদ্দেশ্যে কটু কথা বলে। আবার যুদ্ধ শুরু হল। লক্ষ্মণ পিছু হটল, রামও নাজেহাল হলেন। রণক্লান্ত তরণীসেনও ভাবছেন "আর কতক্ষণ?"!
অবশেষে আবার সেই বিভীষণ নিজের কাজটা করে দিল, জানিয়ে দিল রামকে -
"শুনো প্রভু রঘুনাথ! করি নিবেদন।
ব্রহ্ম অস্ত্রে হইবেক উহার মরণ।।
অন্য অস্ত্রে না মরিবে এই নিশাচর।
সদয় হইয়া ব্রহ্মা দিয়াছেন বর।।"
শ্রীরাম ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেখে তরণীসেন বুঝল, তার যুদ্ধে আসার উদ্দেশ্য পরিণতি পেতে চলেছে, রাক্ষস-দেহ থেকে মুক্তি আসন্ন। শেষ বারের মতো শ্রীরামকে প্রণাম জানাল --
"তোমার চরণ হেরে পরিহরি প্রাণ।
পরলোকে প্রভু! শ্রীচরণে দিও স্থান।।
এতেক ভাবিতে বাণ অঙ্গে এসে পড়ে।
তরণীর মুণ্ড কেটে ভূমিতলে পড়ে।।
দুইখণ্ড হ'য়ে বীর পড়ে ভূমিতলে।
তরণীর কাটামুণ্ড রাম রাম বলে।। "
এরপর অবশেষে বিভীষণ কী বলছে, কীভাবে রামের কাছে প্রকাশ করছে যে তরণীসেন ওরই ছেলে... সেইসব ঘটনা আসে। রাবনের শোক, সরমার বিলাপের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু তরণীসেনের এই পরিণতির পরে সবকিছুই ম্লান মনে হয়ে। কৃত্তিবাস এই স্বল্প পরিসরে তরণীসেনকে একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন যা সত্যিই মনে রাখার মতো একটা প্রয়াস। কিন্তু প্রশ্ন জাগে --
তরণীসেনের চরিত্র কল্পনা কেন করলেন কৃত্তিবাস? ঠিক কোনদিকটা দেখানোর ইচ্ছে ছিল? দৈত্যকুলে তরিণীসেনের মতো লোকও আছে, এটা দেখানো? বিভীষণের যে নেতিবাচক দিক, তা তরণীসেনের মধ্যে ছিল না... তরণী কর্তব্য এবং ধর্মভারে আবেগতাড়িত হয়ে প্রাণত্যাগ করল, বিভীষণ হল লঙ্কাধিপতি... এইটা দেখানোর জন্য? যে কোনো কারণেই হোক, শুধুমাত্র রামের হাতে মরলে মুক্তি পেয়ে বৈকুন্ঠলোকে যাবে -- এই দেখানোর জন্য তরণীসেন চরিত্রটি এনেছেন বলে মনে হয় না। তরণীসেনের নিজস্বতা আছে, প্রভাব আছে। রাম ইচ্ছে করলেই তরনীসেনকে না মেরে বিকল্প কিছু ভাবতে পারতেন, তা যে হল না... এও কৃত্তিবাসের ইচ্ছেতেই। বেঁচে গেলে তরণীসেন সস্তা হয়ে যেত, বিভীষণের মতো 'টু-ফেস' হয়ে যেত। মাইকেল মধুসূধন দত্ত অনেক পরে 'মেঘনাদ বদ' কাব্যে ইন্দ্রজিৎ এবং রাবণকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছিলেন... কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে বসে কৃত্তিবাসের চিন্তায় 'তরণীসেন'-এর আগমন, এও এক রকম মনে রাখার মতো অবদান। নিজেই যেন একটা মিনি মহাকাব্য, অথবা মহাকাব্যের বীজ। পরবর্তী কোনো কবির প্রচেষ্টা হয়ত তরণীসেনকে নিয়েও বড়ো কাজ হতে পারত। হয়ে ওঠেনি।
আর এই যে বললাম, বাল্মিকী রামায়ণে 'তরণীসেন' চরিত্রটি নেই, এই প্রসঙ্গেই বলি -- বাল্মিকী রামায়ণে আছে বিভীষণের কন্যা ত্রিজটার কথা। ত্রিজটা নারী, সে যুদ্ধ করবে না। সে ছিল তার মা সরমার মতই অশোকবনে বন্দিনী সীতার ছায়া সঙ্গিনী। ত্রিজটা কখনো রাবনের গুপ্তচর, রাবণের মন্ত্রনার অংশ। আবার কখনো সে সীতার দুঃখের সঙ্গী, তার মনোবল বাড়াচ্ছে... সীতাকে বোঝাচ্ছে, সে যাতে অবসাদে দুর্দশায় প্রাণত্যাগ না করে । কৃত্তিবাসের চেড়ীরা অন্যরকম, তারা উৎপীড়ন করে সীতাকে। কটু কথা বলে। সেখানে ত্রিজটা বা তার মতো কেউ নেই।
ত্রিজটার মন্দির আছে কাশীতে, সেখানে মেয়েরা ব্রত-উপবাসও করে ত্রিজটার আরাধনায়। এমনকি উজ্জয়িনীতেও আছে ত্রিজটাকে নিবেদিত মন্দির। এমনকি ভারতের বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যেখানে রামায়ণ-গাথা মিশে আছে সংস্কৃতিতে, সেখানেও ত্রিজটার বিশেষ অস্তিত্ব আছে। অথচ ত্রিজটার সীতামাতা তাকে অযোধ্যায় নিয়ে গেলেন না, বললেন "সেখানে রাক্ষসীদের থাকা অসুবিধে... তুমি বরং বারানসী গিয়ে মোক্ষ লাভ করো।"
আবার, তেলুগু মহাকাব্য 'সীতা পুরণামু' তে কবি ত্রিপুরানেনী রামস্বামী বিভীষণকে দ্রাবিড়িয় এবং সরমাকে আর্য্য রমনী হিসেবে পোর্ট্রে করেছিলেন। সরমা এমন এক আর্য্য রমনী যার পরামর্শে ক্রমে বিভীষণ দ্রাবিড়ের থেকে দূরে সরে যায়, নিজের হিতাহিত বুঝে রামের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সরমা চেয়েছিল আর্য্য রঘুপতির বিজয়, এবং রাক্ষসকুলের নাশ। আর্য্য সরমার কন্যা ত্রিজটাও মায়ের শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়েছিল। সরমা আর ত্রিজটার সেবা আর সহৃদয় ব্যবহার রাক্ষস-গৃহে বন্দিনী সীতার বড়ো সহায় হয়ে উঠেছিল। অবশেষে সরমা এবং ত্রিজটাকে সীতার সঙ্গেই অযোধ্যায় চলে যায়।
ত্রিজটাকে নিয়েও কিছু আলোচনার অবকাশ থেকে, কিন্তু বাঙালীর নিজস্ব তরণীসেনের উদয় আর পরিণতি রীতিমতো এপিক-ড্রামার মত। তাই সেই নিয়ে বেশি বলা হয়ে গেল।
[বৈশাখ, ১৪২৭]